পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে যার ব্যাখ্যা বোধ হয় কারই দেওয়া সম্ভব নয়। সাথীর
জীবন এর গল্প টাই যেমন। সাথী ছিল ছিচকাদুনে টাইপের মেয়ে। কথায় কথায় তার নাকি গলায়
অভিমানের সুর আর ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না ট্রেডমার্ক হয়ে গিয়েছিল।
সুন্দরী হবার কারণে কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে অনেক ছেলেই তার সাথে লাইন
মারার জন্য রেডি হয়ে ছিল। ছেলেদের দুর্ভাগ্য, ক্লাসের টমবয় খ্যাত, ছেলেদের
মূর্তিমান যম, পপির সাথে সাথীর বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল প্রবল। পপি আর সাথীর আচার
আচরন ছিল দুই মেরুর, তবু কেন যেন এই দুজনেরই বন্ধুত্ব হল তা ঈশ্বরই বলতে পারবেন।
হয়তো সাথীর করুন অবস্থা হতে পারে ভেবে ঈশ্বর এ দুজনকে বন্ধু বানিয়ে দিয়েছিলেন।
তবুও পপির দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেঙে দু একজন নির্বোধ তবে সাহসী ছেলে প্রপোজ করার
দুঃসাহস করেছিল। তবে এক্ষেত্রে পপির কোন কিছু করা লাগেনি। সাথীর তারস্বরে কান্না
আর পপির রাগী মুডে এগিয়ে আসার দৃশ্য দেখে সবাই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে।
বাবা মায়ের অতি আহ্লাদী কন্যা সাথী কাঁদত কোন কারন ছাড়াই। যেমন, নতুন বই
কিনে নিয়ে আসার পর তার কোন এক পৃষ্ঠার কোনায় অল্প একটু ছেড়া। ব্যাস, হয়ে গেল।
কান্না শুরু। শুরু তো শুরু, থামবার কোন লক্ষন ই নেই। আইলা এসে থেমে যায় কিছুক্ষন
লীলা করেই। কিন্তু সাথীর কান্না আসার এবং শেষ হবার কোন নির্দিষ্ট সময় বোধ হয়
আমেরিকার আবহাওয়া বিদেরাও ধরতে পারতনা। এই ধরনের মেয়েদের জেদ হয় প্রচুর। সাথীও
ব্যাতিক্রম নয়। যা জেদ করবে তা যতক্ষন না হবে ততক্ষন গো ধরে বসেই থাকবে। এর পরও
দাবী না আদায় হলে অব্যর্থ অস্ত্র তো আছেই। বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রই বুঝতে পারছেন,
অস্ত্রটা হল কান্না।
পপির সাথে যে রাগারাগি হতোনা তা না। তবে পপির মেজাজ তিরিক্ষি হলেও সাথীর
জন্য তার হৃদয়ে ছিল আনলিমিটেড অফার। একসময় কলেজের পাট চুকল। আলাদা আলাদা পথে চলা
শুরু হল দুই বান্ধবীর......
৮ বছর পর
পপি আগের তুলনায় অনেক পরিনত। আদর্শ এক রমণী। ভালবেসে বিয়ে করে মধ্যবিত্ত
সংসারের ঘরনী সে। স্বামী, সংসার আর ব্যাঙ্কের চাকুরী নিয়ে সুখেই আছে বলা যায়।
অফিস শেষ করে অনেক্ষন অপেক্ষা করে কোন রিকশা বা সি এন জি না পেয়ে হেঁটেই
যাচ্ছিল সে বাসায়। হঠাত পাশ থেকে তার নাম ধরে ডাকলো যেন কেউ। আশে পাশে তাকিয়ে
কাউকে না দেখে আনমনে আবার হন্টন আরম্ভ করল সে। আবার ডাক শুনল সে। এবার বুঝতে পারল
সে পাশেই এক গাড়ির মধ্য থেকে এক রুপবতী রমনী ডাকছে তাকে। চেহারাটা অনেক পরিচিত মনে
হল তার। এগিয়ে গেল সে গাড়ির দিকে।
‘জ্বি, আমাকে ডাকছেন’।
‘হ্যা, তোকেই ডাকছি। চিনতে পারিসনি আমাকে, ঝাঁসি কি রানী?’ বলতে বলতে বের
হয়ে এলেন সেই ভদ্রমহিলা। পপি চিনতে পারল এবার। এ যে তার কলেজ জীবনের প্রানসখি সাথী। অনেক দিন পর দেখা হলে
বাঙ্গালী যে কাজটা করে, মানে গলা জড়িয়ে কান্না আর কি!, তা হল অনেকক্ষণ।
সাথী বলল, ‘আয় গাড়িতে আয়, তোর সাথে অনেক দিন পর দেখা হল। তোর বাসাও চিনে
আসি। তোর সাথে যেতে যেতে গল্পও করা যাবে’।
পপি গাড়িতে বসলো। দুই বান্ধবীতে আলাপ শুরু হল। পপি তার স্বামী, সংসার নিয়ে
সব বলল সাথীকে। এবার সাথীর পালা। প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইল সাথী। এদিকে পপির বাসার কাছে
চলে এল এরা। অনেক দিন পর দেখা। তাই সাথীর এক প্রকার বাধ্য হয়েই আতিথ্য নিতে হল
পপির। পপির সংসারের সবার সাথে দেখা হল সাথীর। সাথীর দীর্ঘশ্বাস নজর এড়াল না পপির।
সবার সাথে পরিচয় পর্ব শেষ করে সাথীকে নিয়ে পপি বসল ব্যালকনিতে ধূমায়িত কফি নিয়ে।
‘এবার বল তোর জীবনের কথা। কই ছিলি এতদিন? দুলাভাই তো হয়েছে... কি করেন
উনি?’ পপি জিজ্ঞাসা করল সাথীকে।
সাথী শুরু করল তার জীবনের গল্প, ‘কলেজ থেকে পাশ করার পর ভর্তি হলাম
ভার্সিটিতে। বাবার পোস্টিং হয়েছিল ঢাকায়। জীবনটা ছিল খুব মজার। ের মধ্যে পরিচয় হল
এক ছেলের সাথে। ভাল ছাত্র। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মন জয় করে নিল কিছুদিনের মধ্যেই।
শুরু হল প্রেম। সে ছিল মধুময় দিন। বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে তাকেই বিয়ে করলাম। তখনো
পড়াশোনা শেষ হয়নি। বিয়ের পর গেলাম তাদের বাড়িতে। দেখলাম বিশাল ধনী পরিবার। প্রথম
দিন থেকেই শুরু হল কটাক্ষ করা মন্তব্যের বেসাতি। কয়েকদিন যেতে আরম্ভ হল অত্যাচার।
শাশুড়ি আর ছেলে দুজন মিলে জীবনটাকে অসহ্য করে তুললো। তবু মেনে নিলাম। পড়াশোনাতেও
বাঁধা আসলো। ছেড়ে দিলাম বাধ্য হয়েই। বাসার সব কাজ করতাম আমিই। তবু তাদের মন গললনা।
একসময় সে গায়ে হাত তোলা আরম্ভ করল। এক সময় বোধ হল, কি ভুলটাই না করেছি। না বলে
বাসা থেকে বের হয়ে এলাম একদিন।
মাঝে ৮ মাস বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ নেই। ভাবলাম, যাব কি না তাদের কাছে।
তবু মনের বিরুদ্ধে জোর করেই গেলাম বাবা মায়ের কাছে। বাবা কোন কথা বললেননা। ভাবলাম
হয়তো আমার জীবনে আর সুখ নেই। দুই দিন পর বাবা বিচ্ছেদের কাগজ এনে হাতে দিয়ে বললেন
এতে সই করে নতুন করে জীবন শুরু কর। বাবার কথা অনুযায়ী তাই করলাম। শেষ হল জীবনের এক
কালো অধ্যায়ের। সে একবার এসেছিল ভুল স্বীকার করে আমায় ফিরিয়ে নিতে। যাইনি। ফিরিয়ে
দিয়েছি। বার বার ভুল করবনা এই জীবনে- প্রতিজ্ঞা করছিলাম। পড়াশোনা আবার শুরু করলাম।
পরাশনার পাট চুকিয়ে একটা চাকরী জোগাড় করলাম। এখন দুইটা প্রোমোশন পেয়ে সেখানকার
ম্যানেজার পদে আছি। বাবা বিয়ের জন্য বলেছিলেন। করিনি। বাকি জীবন
এভাবেই কাটাব’।
পপি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল সাথীর দিকে। ধাক্কাটা সামলে উঠে জিজ্ঞাসা করল,
‘তুই এতো দুঃখের কথা বললি, এক ফোটা পানিও দেখলাম না তোর চোখে!’
সাথী হেসে বলল, ‘আমার জীবনের গল্প শুনে বুঝিস নি, আমি আর সেই কাদুনি সাথী
নেই। জীবনটাকে আমি উপলব্ধি করেছি’।
পপি হতবুদ্ধি। মনে মনে ভাবল, আসলেই পৃথিবী যেন কেমন? কিভাবে মানুষ কে বদলে
দেয়। এ নিয়ে গড়ে ওঠে এক একটা জীবনের গল্প...