৪
লিফটে চড়ে পৌঁছে গেলাম আটতলায়। আমার আবার উচ্চতাভীতি আছে। লিফটে চড়লেও মনের
ভেতরে বিশাল উদ্বেগ কাজ করা আরম্ভ করে। তবে আমার চেহারা দেখলে কারো বোঝার জো নেই
যে আমি ভয় পাচ্ছি। এ লাইনে এসে এসব বিদ্যে বেশ ভালভাবেই রপ্ত হয়ে গিয়েছে।
লিফট থেকে বেরিয়ে ডানে ৩ নম্বর চেম্বারটা আমার আজকের ক্লায়েন্ট মামুনুল
ইসলামের। সেদিকে হাটা দেয়া মাত্র নীল উর্দি পরিহিত সিক্যুরিটি গার্ড জিজ্ঞাসা
করলেন কার কাছে এসেছি। খুব গাম্ভীরয্যের সাথে উত্তর দিলাম। গার্ড ভদ্রলোক সামনে
থাকা ইন্টারকম দিয়ে কল করলেন মামুনুল সাহেবকে।
‘স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে আসিচ্ছেন’।
ওপাশ থেকে সম্মতিসূচক ইশারা নিশ্চিত হয়ে তিনি আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন আমায়
কোন দিকে যেতে হবে। গার্ড ভদ্রলোকটি কথা খুব কম খরচ করেন। গার্ডদের বোধ করি কম কথা
বলাই অভ্যেস।
মামুনুল ইসলামের চেম্বারের দরজায় তার ছোট্ট একটা পরিচিতি লেখা আছে। বুঝলাম
ভদ্রলোক তার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে যথেষ্ট গর্বিত। তার পরিচিতিতে লেখা,
মামুনুল ইসলাম
ডিএমডি, হেড অফ কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্ট
আজিব ফুডস
আইসিএমএ, এমএসসি ইন কেমিস্ট্রি (পুর্ব-পশ্চিম
বিশ্ববিদ্যালয়),
বিএসসি ইন কেমিস্ট্রি (সবুজ বিশ্ববিদ্যালয়)
চেম্বারের দরজা খুলে দেখলাম একটা টেবিল চেয়ারে মামুনুল সাহেবের ব্যাক্তিগত
সচিব বসে আছেন। তিনি আমায় দেখেই বললেন, ‘ক্রেডিট কার্ড?’
আমি সামান্য হেসে জবাব দিলাম ‘জ্বী, ক্রেডিট কার্ড’।
‘স্যার ভেতরে আছেন। আপনি ভেতরে যেতে পারেন’।
আমি হাসিমুখে সচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা খুলে প্রবেশ করলাম মামুনুল ইসলামের
রুমে।
‘আপনি সাড়ে চার মিনিট দেরি করেছেন’- মিনমিনে আওয়াজে যিনি কথাটা বললেন তাকে আমি
চিনি যদিও দেখিনি। আমার সামনে রিভল্ভিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে আমার দিকে চশমার উপর
দিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন আওয়াজের মালিক, মামুনুল ইসলাম।
৫
‘সময়ের দাম অনেক। আমার সময়ের দাম আরও বেশি। আশা করি বুঝতে পারছেন। সরাসরি
কাজের কথায় চলে যাওয়াটাই বোধ হয় দুজনের জন্য ভাল হবে’।– গাম্ভীর্যের সাথে কথাগুলো
বললেন সামনে বসা ভদ্রলোক।
ভেবেছিলাম সাড়ে চার মিনিটের খেসারত সাড়ে চোদ্দ মিনিট জ্ঞানপুর্ণ অসার বক্তৃতা
শুনে কাটাতে হবে। যাক, ভদ্রলোক এ দিক দিয়ে বেশ ভাল। মিনি নোটবুকটা সবসময় ব্যাগে
থাকে। এতে বিভিন্ন প্রপোজাল সেভ করে রাখা। শুনেছিলাম কাস্টোমারকে শোনানোর পাশাপাশি
দেখিয়ে আরো বেশি আকৃষ্ট করা যায়। তাই এ ব্যবস্থা।
সামনে বসা ভদ্রলোকের গায়ের বর্ণ শ্যামলা। চুল কোকড়ানো। তবে দেখলেই বোঝা যায়
ইনি নিজের বেশ যত্ন নেন। এ ধরনের লোক পটানো সহজ নয়। কিন্তু, আমিও সিনিয়র এ লাইনে।
অভিজ্ঞতা বেশ হয়েছে। তাই ব্যাংক প্রুশিয়ার একটা প্রোডাক্টের বিবরন বের করে তার
সামনে রাখলাম।
‘স্যার, এখানে বেশির ভাগ বিবরনই দেয়া আছে এই প্রডাক্টের। আপনি এতে সর্বনিম্ন
১৫ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্রেডিট লিমিট পাবেন’।
কথা শেষ করার আগেই তিনি হাত তুলে আমায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার ব্যাংকের
ওয়েবসাইটে গতকাল রাতে ঢুকেছিলাম। সেখান থেকে একটা আমার পছন্দ হয়েছে। মাস্টারকার্ড
গোল্ড এ কী কী সুযোগ সুবিধা তা আমি আগেই দেখে নিয়েছি। এর বাইরে আর কি সুবিধা দিতে
পারবেন’।
আমি বিগলিত হাসি দিয়ে বললাম, ‘এর বাইরে আপনাকে শুধুমাত্র ফাস্ট সার্ভিস দিতে
পারবো। এটা আমাদের বেস্ট প্রডাক্ট, স্যার। এ কার্ডধারী ক্লায়েন্টেরা ব্রাঞ্চে
এক্সট্রা কিছু সুবিধা পায়’।
‘ওকে, আমার কাগজপত্র রেডি করতে খানিক সময় লাগবে। কাছাকাছি কোন ব্রাঞ্চে
ব্যবস্থা করুন। পেপার্স রেডি হলেই আমি আপনাকে ফোন দেবো। আমার কার্ডটা নিয়ে যান’।
‘থ্যাংক ইউ, স্যার। আমি আপনার কপ্লের জন্য অপেক্ষা করব’।
কার্ডটা নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে এলাম ভদ্রলোকের চেম্বার থেকে। আমার আর্ধেক
কাজ কমিয়ে আমায় দেখা করতে বলেছেন। ভদ্রলোক নিজেই যে কোন ব্রাঞ্চে চলে যেতে পারতেন।
পরিশ্রম করে ছোট অবস্থান থেকে আজ এখানে এসেছেন বোঝাই যায়। আমার লেগে থাকাকে তিনি
পুরস্কৃত করতে চান তা তো স্পষ্ট। তিনি জানেন এ থেকে আমার কিছু কামাই হবে।
ভদ্রলোকের উপরে শ্রদ্ধা বেরে গেলো।
লিফটে করে নীচে নেমে এলাম। ফ্রন্ট ডেস্কে নীল নয়না তার সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে।
আমার দিকে একবার চোখ পড়লো তার। ঠোঁটে এক চিলতে হাসিও ফুটে উঠলো। আমিও পালটা হাসি
বিনিময় করে বেরিয়ে এলাম বিল্ডীং থেকে। হাসিটা যে আমায় নরম কলজেয় বেধেনি তা বলবনা।
কিন্তু, মাইন্ডসেট ঠিক রাখতে হবে। আমাদের মত লোকেদের হাসিতে বিগলিত হয়ে পড়া
সর্বোচ্চ মাত্রার অপরাধ। এ অপরাধবোধ না থাকলে মাইন্ডসেটে বিঘ্ন ঘটতে পারে!
রাস্তায় বেরিয়ে প্রথমেই গন্তব্য ঠিক করলাম। ক্লায়েন্টের সাথে আলাপ শেষ। এবারে
গন্তব্য ব্যাংক প্রুশিয়ার নিকটতম ব্রাঞ্চ। ওখানে গিয়ে ম্যানেজার আর ক্রেডিট
অফিসারকে ধরতে হবে।