Wednesday, February 10, 2016

ব্যস্ত এ শহরে

প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে ব্যস্ততা। ব্যস্ত মানুষ, ব্যস্ত শহর। কোটি মানুষের ব্যস্ততায় শুরু হয় শহরের দিন। কোথাও কারো এতটুকুন সময় নেই একদন্ড দাড়ানোর। দফতরগামী চাকুরে, বিদ্যালয়গামী শিশু সাথে তার মা, পত্রিকার বিলিকারী, বাজারের ব্যবসায়ী সবাই ছুটছে আপন আপন গন্তব্যে, ছুটে চলেছে এ প্রিয় শহরে।
সকাল ৭ টা বেজে ৩০সঙ্কেতঘড়িটাও ব্যস্তত্রস্ত্রভাবে ডেকে চলেছে আমায়। শহরের এ ব্যস্ততায় শামিল করতে চায় আমাকেও।
আমি বিশাল এ শহরের এক প্রান্তের এক অভদ্র এলাকায় বসবাসকারী এক আলসে ফ্রীল্যান্স ক্রেডিট কার্ড মার্কেটিং এক্সেকিউটিভ। শহরের দক্ষিন প্রান্তের এ এলাকার বাড়িঘর অতটা ভদ্রস্থ নয়। সেকারনে ভাড়াটাও অন্যান্য এলাকার তুলনায় খানিক কম। চিলেকোঠায় ছোট এক রুমের এক ফ্লাটে আমি একাই থাকি। কোন রকমে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড মানুষকে ধরিয়ে দিয়ে সামান্য যে কমিশন পাই তাতে এ এলাকা ছাড়া উত্তরের ঝা চকচকে দালানকোঠায় বসবাস করা স্বপ্নই বটে। তবে, কাস্টমারের সামনে ঝকঝকে তকতকে হয়েই যাই। শত মিথ্যার প্রথম মিথ্যাটা অব্যক্ত। এ মিথ্যাটা প্রথম দর্শনেই বলি আমি স্যুট-টাই দেখিয়ে।
আজ সকাল দশটায় এক বড়সড় ক্লায়েন্টের সাথে দেখা করবার কথা। এঁর পিছনে অনেক দিন ধরেই লেগে আছি। ব্যাংক থেকে যে সম্ভাব্য ক্লায়েন্টের ফর্দটা ধরিয়ে দিয়েছিল তাতে এঁর নামটা প্রথম দিকেই ছিল। মুঠোফোনে আর ইমেইলে বারংবার যোগাযোগ করবার পরে আজকেই তিনি মিটিং এর দিন ধার্য্য করেছেন। তাই প্রস্তুতির ও একটা ব্যাপার আছে।
কাপড়চোপড় রাতেই ইস্ত্রী করে রেখেছি। কোন রকমে সঙ্কেতঘড়িটাকে থামিয়ে চোখ ডলতে ডলতে ফ্লোরবেডিং থেকে উঠে চললাম বাথরুমের দিকে। ফ্রেশনেসটাও এ লাইনে এক বড় ব্যাপার।
নিজেকে ফিটফাট করে বেরোতে সময় লাগলো মোটে ২৫ মিনিট। সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা ডার্বি স্পেশাল খাওয়াটা নিয়মিত অভ্যেস হলেও মাঝে মাঝে অনিয়ম হয়ে যায় ক্লায়েন্টের কাছে যাওয়ার কথা থাকলে। কম দামী সিগারেটে তামাকের গন্ধটা বেশ উগ্র থাকে। ক্লায়েন্টের সামনে ও গন্ধ নিয়ে যাওয়া নিজের পায়ে কুড়াল মারার সমান।
বাসা থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার মোড়ের হোটেলে আমার সকালের নাস্তাটা নিয়মিতই। হোটেলের মালিক কাইউম সাহেবের সাথে সুসম্পর্কের পুর্ণ ফায়দা তুলি মাঝে মাঝে বাকিতে খেয়ে। আজ পকেট দুর্বল। অবশ্য এ দুর্বলতা বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। হোটেলে ঢুকেই ক্যাশে বসা কাইউম ভাইকে দেখে দিলাম লম্বা এক সালাম।
‘আসসালামুয়ালাইকুম কাইউম ভাই, কেমন আছেন?’
‘এইতো ভাইজান ভাল। তয় ব্যবসা খারাপ’।
আমি ভাল করে হোটেলের ভেতরে চেয়ে দেখলাম প্রতিটা টেবিলই ভর্তি। যেদিন এগারোটায় ঘুম থেকে উঠে এখানে আসি সেদিনও একি চিত্রই দেখি। তবুও ভদ্রলোকের মুখে প্রতিদিনই এ কথা কেন থাকে তা আমি ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারিনা।
কাইউম সাহেব মেসিয়ার কে ডেকে বললেন, ‘অই কাসেইম্যা, ভাইজানরে টেবিল ফাঁকা হইলে বহাইয়া দিছ’।
আমি আসন ফাঁকা হবার আশায় দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিক পরে একটা আসন ফাঁকা হল। কাসেম, ছোট খাটো ছেলেটা আমায় ইঙ্গিত করে বসে যেতে বলল। আমি অবশ্য এমনিতেই বসতাম। কিন্তু এ ইঙ্গিতের অর্থ হল সে আমার জন্য বিশেষভাবে খেয়াল করে আর বিল চুকিয়ে যাবার সময়ে তার হাতেও যেন দু’চার টাকা বখশিশ পড়ে। আমিও অবশ্য ওকে সচরাচর নিরাশ করিনা যদিনা নিজের পকেট গড়ের মাঠ হয়।
নাস্তা খেয়ে ক্যাশের সামনে গিয়ে একটা টুথপিক নিয়ে পকেটস্থ করতে করতে কাইউম ভাইকে বললাম,
‘ভাই, আজকের বিলটাও খাতায় তুলে রাইখেন’।
কাইউম ভাই কিছুটা বিরক্তির সাথে পারলে তাকাননা এমন একটা আড় দৃষ্টি হেনে বললেন, ‘ভাইজান, বাকির খাতায় তো শ’পাচেক উইঠা গেলোগা। টাইডা তো মনে লয় নতুন কিনছেন। যাউজ্ঞা, এট্টু তাড়াতাড়ি টাকাটা দিয়েন। বোঝেনই তো এই ব্যবসা কইরাই ফ্যামিলি চালাই’।
আমি ঘাড় নেড়ে ‘তা তো অবশ্যই’ বলে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি জানি টাইয়ের কথাটা উনি কেন বললেন। তবে কথাটা গায়ে মাখিনি। এরকম কথা গায়ে মাখতে নেই। গায়ে মাখিও না। দিনে শতবার শতজনের কাছ থেকে এরকম তাচ্ছিল্যভরা কথা শুনতে শুনতে সব গা সওয়া হয়ে গেছে।
দিলকুশা এলাকায় ভদ্রলোকের অফিস। নীচে রিসিপশনে বসা উর্বশীন্যায় এক মহিলা বসা। কর্পোরেট হাউজগুলো বেছে বেছে এরকম সুন্দরী নারীদের রিসিপশনে নিয়োগ দেন। আসলে সুন্দরের প্রতি মানুষের আকর্ষন বেশি। যেমন, আমি সে আকর্ষনেই রিসিপশনের দিকে এগোচ্ছি যদিও আমি আমার ক্লায়েন্টের বসবার চেম্বার কোথায় তা জানি।
‘এক্সকিউজ মী, ম্যাডাম’
রিসেপশানিস্ট নারী তার নীল চোখ মেলে আমার দিকে চাইলেন। আমি চোখের গভীরে হারাতে গিয়েও ফিরে এলাম। নয়ত ক্লায়েন্ট পটাতে সমস্যা হতে পারে। মাইন্ডসেট ঠিক রাখা জরুরী।
‘ইয়েস স্যার, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?’
‘জ্বী, আমি মামুনুল ইসলামের কাছে এসেছিলাম। হেড অফ কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্ট’।
‘স্যার ৮ তলায় বসেন। লিফটের সাতে। ডানে গিয়ে একটু এগোলেই লিফট পাবেন। বাই দা ওয়ে। আপনি কি এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে এসেছেন?
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তবু, আপনি ফোন করে দেখতে পারেন’
‘না তার দরকার হবেনা। কাইন্ডলী ভিজিটরস বুকে একটা সাইন করে যান’
দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করছি কিন্তু তাকিয়ে আছি ডেস্কে বসা ললনার দিকে। তিনি একটু নড়েচড়ে বসলেন। বুঝলাম তার ইতস্তত বোধ হচ্ছে। হয়তবা নতুন। নয়ত এ দৃষ্টিতে তো পুরোনদের অভ্যেস হয়ে যাবার কথা। বইটা ফেরত দিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘জীবনানন্দ বোধ হয় আপনার মত কাউকে দেখেই বনলতা সেন লিখেছিলেন। তবে, যাকে দেখেছিলেন তার চোখ বোধ হয় নীল ছিলনা। হলে হয়ত লিখে যেতেন। ভাবছি আমিই কিছু লিখে ফেলবো’
মেয়েটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। আমি রওনা দিলাম লিফটের দিকে। পেছনে ফিরে তাকালাম না। জানি পিছনে ফিরে তাকানো মানেই প্রেমে পড়ে যাওয়া। মাঝেমাঝেই এমন প্রেমে পড়ি আমি। অবশ্য প্রেম কাটিয়ে উঠতে সময়ও আমার লাগেনা। তবু, আজকের দিনটা আলাদা। মাইন্ডসেট ঠিক রাখা প্রয়োজন।

No comments: