Friday, November 2, 2018

প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন ও পৌন্ড্রক বাসুদেব

পৃথিবীতে বাঙালি ছাড়া আর কোন জাতি আছে কী না যাদের কোন প্রাচীন ইতিহাস নেই, তা সম্পর্কে আমি সন্দিহান। হাজার বছরের সংস্কৃতি হিসেবে যে মহাপদযাত্রাকে ইউনেস্কো দ্বারা স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে তারও আরম্ভ এই গত শতাব্দীর শেষভাগে কিছু ধুরন্ধর বেনিয়ার মাথা থেকেন উদ্ভুত। যদিও বঙ্গাব্দের শুরুটা ৫৯৪ সালে রাজা শশাঙ্কের আমলে (আনুমানিক এবং অস্পষ্ট তথ্যসূত্র)***


মহাভারত এ উল্লেখ আছে বঙ্গ, কলিঙ্গ, সমতট, পুন্ড্রবর্ধনের কথা। যারা দুর্যোধনের সাথে সঙ্গী হয়ে সে মহাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল কৌরবদের পক্ষে। সে যুদ্ধে কৌরবেরা পরাজিত হয় এবং শাসনভার চলে যায় ধুরন্ধর আর্যদের কাছে। ইতিহাস সবসময় বিজয়ীদের দ্বারাই লেখা হয় এবং পরাজিতের ইতিহাস চলে যায় কালের অতল গহ্বরে। তেমনি হয়ত এ অঞ্চলের অর্থাৎ বঙ্গভুমির সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের ইতিহাস হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। এরপরের ইতিহাস তো পরাজয়ের আর রক্তক্ষয়ের। কখনো আর্য, কখনো তুর্কী, আফগানি বা মধ্যপ্রাচ্যের ভিখিরিরা এ অঞ্চল শাসন করেছে গলায় তরবারি ধরে বা নতুন কোন ধর্মের আমদানি করবার মাধ্যমে। আলীবর্দী-সিরাজোদ্দৌলারাও বাঙালি ছিলেন না। এরপরে ব্রিটিশদের দুইশত বছর আর পাকিস্তানিদের চব্বিশ বছর গোলামী করে ১৯৭১ সালে স্বাধীন এবং নিজেদের একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাঙ্গালীদের জন্যে। মহাভারতের যুদ্ধ খৃষ্টপূর্ব ৩১০২ (আর্যভট্টের হিসেব অনুযায়ী) সালে সংঘটিত হয়। যার অর্থ প্রায় ৫০৭৩ বছর পরে এ অঞ্চলের বাঙ্গালীরা একটা রাষ্ট্র গঠন করতে পেরেছে যা ৪৭ বছর ধরে টিকে আছে। এর মাঝে শশাঙ্ক এবং তার পুত্র মানব ২৬ বছরের এক স্বাধীন রাজ্যের অধিপতি হিসেবে ছিলেন যা পদ্মার মাঝে একফোঁটা জলের মতই লাগে। 

মহাস্থানগড়, বগুড়া শহর থেকে ১১.৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এক প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ সমৃদ্ধ এলাকা। প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী ছিল এ শহর। যদিও এখনঅব্দি ধ্বংসাবশেষ থেকে খৃষ্টপূর্ব তিনশ অব্দের (কার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে প্রাপ্ত) পর্যন্ত কিছু জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছে, এর ইতিহাস আরো প্রাচীন। এ অঞ্চলে মহাভারতের যুদ্ধের সময়য় পৌন্ড্রক বসুদেব নামে একজন রাজার নাম আমরা জানতে পারি মহাভারত এবং অন্যান্য পুরাণ থেকে যিনি মগধ রাজ্যের অধিপতি জরাসন্ধের একজন মিত্র ছিলেন এবং মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষে পান্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। 

পৌন্ড্রক বসুদেবের সাথে যাদব বাসুদেবের ছিল শত্রুতা যা পুরানে উল্লেখ আছে। মগধরাজ জরাসন্ধ এবং পৌন্ড্রক বসুদেব মিলিতভাবে একের পর এক আঠারোবার মথুরা আক্রমণ করে কৃষ্ণকে একবারে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। এমনকি শ্রীকৃষ্ণ পৌন্ড্রক বাসুদেব এবং জরাসন্ধের এরকম নিত্য নৈমিত্তিক আক্রমণ থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য সকল যাদবদের নিয়ে পশ্চিম সাগর তীরবর্তী দ্বারকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ইতিহাস শ্রীকৃষ্ণকে দিয়েছে দেব এর সম্মান। দেব শব্দটির উৎস যদি দেখা হয় তা প্রাচীন ইরানীয় বা আর্য দেওএর থেকে উদ্ভুত যার সাধারনীকৃত অর্থ শয়তান। সত্যই কুটিল এ মানব তার জীবদ্দশায় প্রাচীন ভারতের নকশা যেভাবে পরিবর্তন করেছেন তাতে অন্তত আমার কাছে তিনি দেও-ই। পৌন্ড্রক বসুদেব এর পুন্ড্রবর্ধন তখন ছিল সামরিক পরাশক্তি। ইতিহাস আমাদের জানায়, হাতিকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করতে জানত এই বঙ্গ অঞ্চলের মানুষ অতি প্রাচীনকাল থেকেই। সামরিক শক্তি আর দেশপ্রেমে অভাব না থাকা সত্ত্বেও কেন ৫১২০ বছর আগে উত্তর ভারতের মহাভারতের যুদ্ধে পরাক্রমশালী এক সামরিক জোট এর পরাজয় ঘটল সামান্য কিছু বহিরাগত আর্যের কাছে তা এক বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্নই অনুসন্ধিৎসু মনের কাছে। 
উত্তরটা হয়ত চোখের সামনেই,

বিশ্বাসঘাতকতা

কে না জানে এ ভূমির মানুষের দুর্বল নৈতিক চরিত্রের কথা। কিন্তু, এ মহাবিপর্যয়ের কারন হিসেবে জানা প্রয়োজন কে এবং কেন? হয়ত উত্তরগুলো উত্তরবঙ্গের মহাস্থানগড় বা কোন প্রাচীন শহরের মাটির নীচে অনাবিষ্কৃত হয়ে আছে। যেগুলো আবিষ্কার হলে কৃষ্ণের ভগবানত্বে একটু হলেও দ্বিধা আনবে। হয়ত বাঙালিদের দেবতা হিসেবে নতুন সংযোজন হিসেবে দেবতাদের বিশাল তালিকায় আবির্ভুত হবেন পৌণ্ড্রক বসুদেব। আর্যরা হয়ত বুদ্ধ আর শিবের মতো পৌণ্ড্রক বসুদেবকেও আর্যদেবতা বানিয়ে ফেলবে।

এটাও আরেকটা বড় প্রশ্ন আর্যাবর্তের ঘুর্ণিপাকে স্বাধীনতা হারানো অন্যের গোলামীর শীর্ষতালিকায় অবস্থান গড়া এক জাতি আদৌ এতে উৎসাহী হবে কীনা!






*** সম্রাট আকবরের সময়কালের অনেক আগের তৈরি করা দুই শিব মন্দিরে বঙ্গাব্দ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

No comments: