Saturday, April 19, 2014

সায়াহ্নে ভোরের স্মৃতি

সকালে পুর্বাকাশে সুর্যদেব তার আপন মহিমা নিয়ে পুর্বাকাশে উদিত হন। আবার সায়াহ্নে পশ্চিমাকাশে অস্ত যান। মাঝের এই সময়টা তিনি প্রত্যক্ষ করেন কি কি ঘটল। মানুষের জীবনটাও বোধ করি এমনই। জীবন সায়াহ্নে এসে এই কথা খুব উপলব্ধি করছি আমি।
আমি সাঈদ। জীবনে এমন কিছুই করিনি যা দিয়ে মানুষ আমায় মনে রাখবে। হ্যাঁ, নিজের মুখে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। সুর্যের মত উদয় হয়েছিলাম এক কৃষক পরিবারে খুব অল্প দীপ্তি নিয়ে। শৈশব- কৈশোরটা চরম দারিদ্রেই কেটেছে। যুবক বয়সে নিজের ভাগ্যান্বেষনে ঘর ছেড়েছিলাম। জানি কিছুই করতে পারিনি তার মধ্য দিয়েও অনেক কিছুই করেছি। নাহ, আমি আমার প্রথম জীবন নিয়েই কথা বলবো। যা আমাকে আজও আনন্দ দেয়, কষ্ট দেয়, আলোড়িত করে। প্রারম্ভিকা তো করলাম অনেকখানি। বয়স হয়েছে তো তাই একটু বেশি কথা বলি। থাক শুরুই করি কেমন ছিল সেই শৈশবের দিনগুলো।
কবে জন্মেছিলাম তার কোন ঠিক তারিখ আমি জানতে পারিনি। বাবা- মা দুজনেই ছিলেন ক- অক্ষর গোমাংস। আমি তাদের ছোট সন্তান। বাবা ফুটবল খেলা জানতেন বোধ হয়। তাই গুনে গুনে এগারটা সন্তান জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন।  তবে ফুটবল টিমটা বাবার স্বপ্ন অনুযায়ী হয়নি। কারন এই এগারোজনের মাঝে ৪ জনই মেয়ে। বাবা নামাজী ব্যাক্তি ছিলেন, আরবী নাম তার খুবই পছন্দ ছিল। নাম রেখেছিলেন আমার সঈদ। মা রেখেছিলেন মানিক। শেষ পর্যন্ত বাবার রাখা নামটাই থেকে গেছে। শুধু সঈদ এর ‘স’ এর সাথে একটা আ-কার যুক্ত করেছিলাম আমি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেবার সময়। আমি জন্ম থেকেই একটু গোলগাল ছিলাম আর গায়ের রংটা ছিল একটু সাদার দিকে। মা এতেই খুব খুশি ছিলেন। বাবা দারিদ্রের কষাঘাতে পিষ্ট ছিলেন তাই আহ্লাদ অতটা প্রকাশ করতেন না। ছোটবেলার কথা খুব বেশি মনে নেই। দুই বছর আগের কথাই যেখানে স্মৃতিতে ঝাপ্সা সেখানে অত বছর আগের কথা কিভাবে মনে থাকে? এটুকু মনে আছে ব্র ভাইজানের কাঁধে চড়ে স্কুলের স্পোর্টস দেখতে গিয়েছিলাম। ভাইজান তখনও ছাত্র। আসলে তিনি ছাত্র থাকতেন না যদিনা ২ বার মেট্রিকুলেশন ফেল করতেন। থাক তাও ভাল তা না হলে তো এই ঘাড়ে চড়ে স্কুলে যাবার কথা মনে থাকতনা!
স্কুলে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ গানটা গাচ্ছিল মানুষ খুব মন দিয়ে। আর মাঠে পাকিস্তানের চান- তারা পতাকা পতপত করে উড়ছিল। ভাইজান আমাকে তার এক স্যারের কাছে বসিয়ে রেখে লং জাম্প খেলেছিলেন। ফার্স্ট হয়েছিলেন আর পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন একটা শিল্ড। আমার যে কি আনন্দ ছিল! আধো আধো বুলিতে স্লোগান দিতে দিতে ফিরেছিলাম ভাইজানের নামে।
এরপরের কথা মনে আছে প্রথম দিন স্কুলে যাবার কথা। মা সুন্দর কাপড়- চোপড় পরিয়ে মাথায় একগাদা সরিষার তেল ঢেলে আদর করে বললেন, ‘যাও বাজান। ইস্কুলেত যাইয়ে কারুর সাথে মারামারি কইরো বোচর। সবার সাথে ভাল কইরে চইল আর মাস্টরে কথা মন দিয়ে শুইনো’। আমি খুবই ভাল ছেলে ছিলাম তাই ঐ বয়সেই সমবয়সী তিন- চার জনের মাথা ফাটিয়ে বিশেষ উপাধি পেয়েছিলাম। মা তাই সারাক্ষন ভয়ে থাকত রাগ করে কাকে না কি করে বসি। রাগটা পেয়েছিলাম বাবার কাছ থেকে। বাবার রাগের কথা যখন আসলই তখন একটা বিবরন দেওয়া যাক।
বাবা মাঠে কাজ করছিলেন। এরই মধ্যে আমাদের প্রতিবেশি পরিবারে ঝগড়া লাগলো। ঝগড়া তো ভীষন মারাত্নক আকার ধারন করল। বউ চলে যাবে বাপের বাড়ি। বাবাকে কে যেন খবর দিল ‘দুদু, সাইজান তো বউর সাথে ছাড়াছাড়ি কইরে ফেলতিছে’। বাবা কাজ ফেলে ছুটে চলে এলেন বাড়িতে। গেলেন মিটমাট করতে। আমি তখন ঘরে শুয়ে ছিলাম। একটু পরে শুনলাম আমাদের বাড়িতে আগুন দিতে আসছে সাইজানেরা। আমার বড় ৫ ভাই (আমার আগের জন আমার চেয়ে দেড় বছরের বড়) লাঠি নিয়ে নেমে গেল উঠানে। আমি মায়ের কোলে শুয়ে ছিলামবদি ভাই পাশে মায়ের আচল ধরে বাইরে মারামারির এন্তেজাম দেখছিল আর বিছানা ভেজাচ্ছিল ভয়ে। পরে শুনলাম বাবা নাকি ঐ ঝগড়া থামাতে গিয়ে দমাদম মারতে আরম্ভ করেছিলেন সাইজানকে। সাইজানের বউই নাকি প্রথম হুমকি দিয়ে ঝাপিয়ে পরে বাবার উপর স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে। পরে বাবাও দমাদম পিটাচ্ছিলেন দুজন কে। এরই মধ্যে অন্যান্য ব্যাক্তি জড়িয়ে গেলে বিশাল আকার ধারন করে ঝগড়া। যা শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে আমাদের পরিবারের উপরে। হাসি পাচ্ছে না শুনে? আসলে এমনই ছিলেন আমার বাবা, মৃত্যুর দিন পর্যন্ত।
আমিও বাপের ব্যাটা ছিলাম। প্রথম প্রথম চুপচাপ ছিলাম। একটু স্বাস্থ্যবান ছিলাম বলে সমবয়সীরা ক্ষেপাত। একদিন একটাকে ধরে দিলাম এয়সা কষা যে বাকিগুলো তটস্থ হয়ে গেল। আর আমি হয়ে গেলাম ওদের লিডার। খুব শক্ত হাতে ছেলেপুলেদের নিয়ন্ত্রন করতাম। আর মায়ের কাছেও বিচার যেতো খুব ঘনঘন। তবে মা কিছুই বলতেন না আমায়। শুধু ঠান্ডা গলায় বলতেন, ‘আর ইরম করলি কিন্তুক তোর ভাত বন্ধ কইরে দিবানি’।
আমার এসব ক্ষেত্রে শাস্তি দিতেন বড় ভাই আর সেজো ভাই। এই দুজন আমাকে পিটিয়ে যে কি স্বর্গসুখ(!) লাভ করতেন জানিনা। মাঝে মাঝে মা কড়িকাঠ দিয়ে ঐ দুজনকে ঠেঙ্গিয়ে আমাকে উদ্ধার করতেন। আমিও ভাল ছিলাম! মার খেয়ে আধা ঘন্টা প্যা প্যা করে কেঁদে মাকে অতিষ্ঠ বানিয়ে ফেলতাম। মাও আমাকে রেখে যেতেন তার কাজে। এত বড় সংসার একা হাতে সামলানো তো চাট্টিখানি কাজ নয়। আমার জন্য এত সময় বরাদ্দ করলে বাকিদের কি হবে? আসলে আমার বড় তিন বুবুর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আমার জন্মের আগেই। এমনকি আমার তিন ভাগ্নে বয়সে আমার চেয়েও বড়। আমি হাইস্কুলে থাকতে নাতির মুখ দেখেছিলাম।
ছোটবুবুর বিয়ের সম্বন্ধ আসলো একদিন। পাড়ার মাঠে কাবাডি খেলছিলাম। এর মধ্যে বন্ধু বাকীবিল্লাহ এসে বলল বুবুকে নাকি দেখতে এসেছে। আমি তা গায়েই করিনি তখন। খেলা শেষ করে যতক্ষনে বাড়িতে ফিরে দেখি সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ। বাবা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ‘হারামজাদা, তুই এন্নে আস্তিছিস বাড়িত?’ মা আমাকে ছো করে তুলে নিয়ে বাচালেন। বিয়েবাড়ি বলেই হয়ত বেঁচে গেছিলাম সেদিন।

মাঝে মাঝে মনে হত বাড়িতে আর ফিরবনা। শৈশবে আমার বয়সী ছেলেদের লীড দিতাম আমি আর আমাকে এভাবে মার খেতে দেখে অন্যরা লুকিয়ে হাসত। মান সম্মানের একটা বিষয় আছেনা! অনেক দিন বাগানে গিয়ে বসে থাকতাম পুরো বিকাল। সবাই আমাকে খুজতো। আমি তো রাগ করেছি... তো ফিরবো কেন? কিন্তু মাগ্রেবের আজান শুনে আমি ঠিকই ঘরে ফিরে যেতাম। সন্ধ্যার আঁধারে আমার ছিল রাজ্যের ভয়। তার চেয়ে বড় কথা মায়ের আঁচলের গন্ধ না পেলে আমি ঘুমুতেই পারতাম না। হায়রে মা, তার শেষ দিনটাতে আমি পাশে থাকতে পারিনি। অথচ শৈশবের একটা দিনও মাকে ছাড়া কল্পনা করতে পারতাম না। আর আজ, আমিও দিন গুনছি মায়ের সাথে আবার দেখা হবে ওইপারে। মাঝে মাঝে তো মনে হয় মা আকাশে তারা হয়ে আমাকে ডাকছে। কাউকে অবশ্য বলিনা এই কথা। কে চায় বুড়া বয়সে এসে ‘বাচ্চা’ ট্যাগ খেতে?

Wednesday, April 2, 2014

থ্রিপিস



রাশেদ দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে। সাথে ওর বন্ধু ইকবাল। বারবার ঘড়ির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে রাশেদেরতৃষার আসার কথা তাই এ অপেক্ষা। একটা নতুন থ্রিপিস কিনে এনেছে আজ তৃষার জন্য। চার মাস হতে চলল প্রেমের বয়স কিন্তু তৃষাকে কখনও কিছু কিনে দেওয়া হয়নি। আজ তৃষার জন্মদিন। আজ তো কিছু দিতেই হয়। এই রকম একটা থ্রিপিসের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল তৃষা। সেদিন দুজনে গিয়েছিল বলধা গার্ডেনে। গার্ডেন থেকে বেরিয়েই কয়েকটা শোরুম। একটা শোরুমে ঝুলছিল পোশাকটা। রাশেদ লক্ষ্য করেছিল ব্যাপারটা। ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই কিনে উপহার দিতে থ্রিপিস টা তৃষাকে। কিন্তু টিউশনি করে চলা রাশেদের মাসের অর্ধেকই চলে আধাবেলা খেয়ে। তাই আর সেদিন কেনা হয়নি।
নতুন টিউশনি একটা জোগাড় হয়েছিল গতমাসে বহু কষ্টে। বেতন চার হাজার টাকা। সারা মাস পড়িয়ে গতকালই বেতন পেয়েছে রাশেদ। সেই বেতন থেকে পঁয়ত্রিশশো টাকা দিয়ে থ্রি পিসটা কিনেছে সে। তৃষা মহানগর মহিলা কলেজে পড়ে। বাসা ফকিরাপুলে। রাশেদেরও তাই। রাশেদ খুব গোপনীয়তার সাথে তৃষার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। কারন তৃষা বলেছে বাসায় জানলে সমস্যা হবে। তাই কখনও বলধা বা কখনও রমনা গার্ডেনে অভিসারে মাতে ওরা। দুজনে কাছাকাছি হলেই শরীরে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে দুজনার। নিভিয়েও নেয় প্রেমকাননের কোন নিভৃত বৃক্ষতলে। প্রথম প্রথম তৃষা ইতস্তত করত। এখন নিজ থেকেই এগিয়ে আসে এই ব্যাপারে।
তৃষার কলেজ পুরান ঢাকায় তাই এদিকটাতেও আসা হয়না দুজনার একসাথে। তৃষাও নিষেধ করেছে এখানে আসতে। রাশেদ আসেওনা। আজ একটা সারপ্রাইজ দেবে তৃষাকে। তাই এখানে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। আজ তৃষার বান্ধবীরাও জানুক না তৃষার প্রেমিক আছে যে তাকে মাঝে মাঝে উপহারও দেয়।

ঘড়িতে সময় ১১ টা।
ইকবাল- এখনই তো ছুটি হবার কথা।
রাশেদ- হ্যাঁ, গেট থেকে মেয়েরা বের হয়ে আসছে। ওইত তৃষা।
ইকবাল- এদিক ওদিক কি দেখছে? রিকশা খুঁজছে নাকি? আরে বাইকটা ওর সামনে এসে দাঁড়ালো কেন?
রাশেদ- ছেলেটাকে চেনা মনে হচ্ছে।
ইকবাল- কায়েম! কি আশ্চর্য! তৃষা ওর বাইকে হাসতে হাসতে চড়ে বসল কেন? আরে, কায়েম বাইক নিয়ে তো এদিকেই আসছে।
রাশেদ- পেছনে ফিরে দাড়া ও যেন আমাদের না দেখতে পারে।
ইকবাল আর রাশেদ পেছনে ফিরে দাঁড়ালো। রাশেদের মন চাচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে। চোখ ভিজে গেছে ওর। ইকবালের মুখেও কথা নেই। ও বুঝে গেছে সব। হাত ধরে টানছে রাশেদের। রাশেদ পিছনে ফিরে দেখল, জ্যামে কায়েমের বাইক আটকা পড়েছে। তৃষা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মুখে ক্রুর হাসি। এতক্ষনে রাশেদ লক্ষ্য করল তৃষার পরনের থ্রিপিসটা হুবহু ওর উপহারের জন্য কেনা থ্রিপিসের মত...
পুনশ্চঃ

রাশেদ থ্রিপিসটা গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে ছোট বোনের জন্য। সাথে একটা ছোট চিরকুট পাঠিয়েছে- ‘তোর জন্য খুব দাম দিয়ে কিনলাম। তোরা ছাড়া এই পৃথিবীতে দামী আর কে আছে?