১।
সুর্যের আলোটা জানালার ফাঁক গলে চোখে পড়তেই মুঠোফোনের এলার্মটা বেজে উঠল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে এলার্ম বন্ধ করে ঘুমকাতুরে আমি এক চোখে দেখলাম বাইশটা নোটিফিকেশন জমেছে। সারারাত ওয়াইফাই অন ছিল। বেজেছেও মোবাইলের সুর কিন্তু সারা সপ্তাহ অমানুষের মত পরিশ্রম করা এই আমার ছুটির দিনের ঘুম ভাঙ্গানোর মত শব্দ যে ওগুলো ছিলোনা তা বলাটা অত্যুক্তি হবেনা।
হোয়াটসঅ্যাপ এবং মেসেজবক্সে ক্ষুদেবার্তা এসেছে এতগুলো। আইডি এবং নম্বর দুটোই অপরিচিত। সকাল সকাল অপরিচিত আইডি থেকে পাঠানো স্প্যামবার্তাগুলো আর দেখতে মন চাইলো না। এর আগে যতবারই এমন বার্তা এসেছে খুলে দেখেছি হয় মিটমিট জ্বলতে নিভতে থাকা লাইটে শুভ সকাল এর এনিমেশন ছবি নয়ত দুটো কবুতরের একডালে বসে থাকা ছবির সাথে বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় বানী। এমনিতেও সকাল ছয়টায় এলার্ম যে দেওয়া তা কেন গত রাতে মনে করে বন্ধ করে রাখিনি তা ভাবতেই নিজের উপরে রাগ নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছেনা। তার উপরে সপ্তাহান্তের এই বিশ্রামের জন্য বরাদ্দ সকালে অকালে ঘুম ভাঙ্গার পর তা যে আর শুভ সকাল থাকেনা তা এই স্প্যামারেরা বোঝেনা।
বিছানা থেকে নামতে মন চাইছেনা। মন চাচ্ছে আরও খানিকক্ষণ ঘুমাতে। কিন্তু একবার যেহেতু ঘুম ভেঙ্গে গেছে তা আগামী এক ঘন্টায় আর ফেরত আসবেনা। অগত্যা তা মেনে নিয়ে কর্মবীরের মত ছুটির দিনের জন্য ফেলে রাখা কর্মগুলোর মুখোমুখি হওয়াই ভাল। বিছানা থেকে নেমে ব্রাশে খানিকটা পেস্ট নিয়ে পা বাড়ালাম ছাদের দিকে।
আসলে ছাদেই আমার বাস। অন্যভাবে বলা যায় আমার দেড় রুমের এই বিশাল ফ্লাটের উঠোন ওটা। বাড়িওয়ালা নিজের জন্য আলাদা একচিলতে জায়গা হিসেবে বানিয়েছিলেন এই চিলেকোঠাটা। ছাদের এই অংশে একমাত্র এই ঘর দিয়েই ঢোকা যায়। ছাদের অন্য পাশটা এই বাড়ির অন্য সব বাসিন্দাদের। বাড়িওয়ালা মারা গিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। উনার স্ত্রী মানে রওশন চাচী অনেকদিন এই ঘরটা তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। দুই ছেলে মেয়ে যার যার ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে থাকে অন্য জায়গায়। মাঝে মাঝে আসে তারা ভাড়া নিতে। মায়ের হাতখরচের জন্য যে টাকা দেয় তাতে হয়না বলেই নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমার কাছে ফ্লাট ভাড়া দিয়েছেন আন্টি। তবে,
আমার জন্য যে বেশ হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। রাজধানী থেকে ট্রান্সফার হয়ে এই উপজেলা শহরে আসতে হবে ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারন,
বাসা ভাড়া পাওয়া যায়না। ব্যাচেলর ছেলেদের কেন যেন বাড়িওয়ালারা বাসা ভাড়া দিতে চায়না। হোক সে রাজধানী, জেলা শহর, উপজেলা শহর বা মফস্বল। সেখানে ভাগ্য আমার এতটাই ভাল দুই রাত কলিগের মেসে ,যা আবার অফিস থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে, গাদাগাদি করে থাকার পর তৃতীয় দিন সন্ধ্যায়ই পেয়ে গেলাম আমার এই ছোট্ট রাজপ্রাসাদ।
সেদিন আসলে অফিস থেকে বেরিয়ে একটু উলটো পথে যেতে মন চাইল। সরকারী ব্যাংকে চাকরি করি। এ শাখায় চাপ বেশ কম থাকে মাসের শুরুর দিকে। পাঁচটা বাজতেই বেরিয়ে যাওয়া যায়। ব্যবস্থাপক অবশ্য আরও আগে বেরোন। সবচেয়ে সুখের বিষয় এখন অব্দি বায়োমেট্রিক হাজিরাযন্ত্র লাগানো হয়নি এই অফিসে। সেই সুযোগটাই কাজে লাগায় সবাই। ঐ দু তিনটে দিনই একটু শান্তির। এরপরে যা চাপ। মাসের তিন তারিখ ছিল সেদিন। আগে আগে বেরিয়ে উলটো পথে আধা কিলোমিটার হেটে ডানপাশে একটা সরু গলি দেখলাম। একটু বেশিই নীরব। জানিনা কেন যে ঢুকলাম এই রাস্তায়। গলির দুই পাশেই দশটা করে বাড়ি। তবে ডানের দশ নম্বর বাড়িটার এক প্লট পরে আরেকটা বাড়ির সামনে দেখলাম এক সম্ভ্রান্ত চেহারার বৃদ্ধা লাঠীর আগায় করে একটা কিছু দরজার উপরে লাগানোর চেষ্টা করছেন। ভাবলাম একটু সাহায্য করি। তাই এগোলাম। এগিয়ে দেখি কালো টিনের পাতে ‘ঘর ভাড়া’ লেখাটা আমার দিকে তাকিয়ে মিটী মিটি হাসছে। কোন ভনিতা ছাড়াই বৃদ্ধাকে মানে রওশন চাচীকে জিজ্ঞাসা করলাম একাকীত্বের সোল ডিস্ট্রিবিউশন নেয়া যুবককে ঘর ভাড়া দেবেন কী না। তিনি কিছুক্ষন অবাক তাকিয়ে থেকে বললেন, উপরে এসো’।
দোতলায় ছিমছাম একটা ঘরে গিয়ে বসলাম। আন্টি ভেতর থেকে দুটো প্রমাণ সাইজের পেয়ারা কেটে এনে আপ্যায়ন করার ফাঁকে নাড়ী নক্ষত্র জেনে নিলেন। সব জেনে বললেন আমি ঐ মুহুর্তেই উঠতে পারি বাসায়। আমি অগ্রীম হিসেবে কিছু টাকা দিতে চাইলে তাতেও মানা করে বললেন আমি যেকোন সময় উঠতে পারি, তিনি আর ঐ টিনের পাত লাগাতে নামতে আগ্রহী নন। পরদিন বাসায় উঠে আমার চক্ষু চড়কগাছ। ছাদে দাঁড়িয়ে রুপসা নদীর তীর দেখা যায়। ঘরটাও বেশ সুন্দর। সোজা কথায় একটা কমপ্লিট প্যাকেজ।
শুক্রবারের সকালটা আসলে আমার কেটে যায় এই ছাদেই। শরীরচর্চা করতে আসি বটে তবে কাব্যচর্চা করেই সময় কেটে যায়। ব্রাশ করতে করতে দুটো লাইন মাথায় আসছিল মাত্র মুঠোফোনের বিপ বিপ আওয়াজে তালটা কেটে গেল। হাতমুখ ধুয়ে, চায়ের কেতলীটা চুলোয় বসিয়ে মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে বার্তাগুলো মুছে দেয়ার নিয়ত নিয়ে বসলাম আমার সিংহাসনে। হোয়াটসঅ্যাপ এ একটাই মেসেজ। তা এসেছে আমার কন্ট্যাক্ট লিস্টে না থাকা কোন নাম্বার থেকে। তাতে লেখা ‘তোমার মেসেজ বক্স চেক কর’।
লেটেস্ট বার্তা সহ আগের একুশটা বার্তা বিভিন্ন প্রমোশনাল কাজে আমায় পাঠানো হয়েছে। প্রথম বার্তা যেটা রাত ১টা ৫ এ পাঠানো হয়েছিল সেটা এসেছে অনেকটা শর্ট কোড এর মত নাম্বার থেকে। ২৪৩৯।
বার্তাটা খুললাম। তাতে লেখা, ‘তোমার চাচীর সামনে ভীষণ বিপদ। তুমিই বাঁচাতে পারো তাকে। সূত্র বার্তার নম্বরে। ফিরতি বার্তায় ফাঁকা মেসেজ দিও। আশফাক’।
আমার কোন চাচী বিপদে আর কোন চাচা আমায় এরকম বার্তা পাঠাতে পারে তা ভাবতেই অবাক লাগলো। আমার আশফাক নামে কোন চাচা নেই। যে চাচারা আছেন তাদের নাম ভুলেই গেছি লুসিফার আর আযাযীল নামে ডাকতে ডাকতে। ফিরতি মেসেজ দেওয়ার আর দরকার মনে হলোনা কারন ইতিমধ্যেই সাড়ে ছয় ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আর দেরি করলে নদীর তীরের সদ্য পাওয়া মাছগুলো যে ফুরিয়ে যাবে তা ভাবতেই ভেতর থেকে অন্যরকম কম্পিটিটিভ সত্ত্বাটা জেগে উঠল। অগত্যা বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে দ্রুত ঘর তালা দিয়ে নামলাম নীচে। বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করতে করতেই একটা রিকশা এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনে। এক সুন্দরী তন্বী নামলো রিকশা থেকে।
‘এক্সকিউজ মি, এটা কী মিসেস রওশন মীরের বাড়ি?- মিঠাই দিয়ে উপচানো মিষ্টি গলায় জিজ্ঞাসা করলো তরুনী। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আসলে সুন্দরী মেয়েদের সাথে আমি গলা খুলে কথা বলতে পারিনা। জিহবাও বিদ্রোহ করে। শব্দগুলো ঠিকঠাক ফুঁটে বেরোয়না।
তরুনীটি ভাড়া মিটিয়ে আমার দিকে ফিরে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কয় তালায়?’
আমি
‘দুই’
বলে বাম পাশের জানালার দিকে ইঙ্গিত করে দিলাম। তরুনীটিও ‘ধন্যবাদ’ বলে দরজা খুলে ভিতরে চলে গেল। এই
‘ধন্যবাদ’
কতক্ষন ধরে কানে বাজছিল জানিনা তবে শ্যাওলা পড়া দেওয়ালে শ্যাওলার আড়ালে প্রায় চোখে না পড়ার মত নামফলকের মর্মোদ্ধার করামাত্র মেরুদন্ডে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। নামফলকে লেখা,
আশফাক
ভিলা
আশফাক
মীর এবং রওশন মীর
বাড়ি
২৪, সড়ক ৩৯
মীরেরচালা,
রুপসা, খুলনা
২।
মেয়েটা
সিড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠা মাত্রই মাথা চকর দিয়ে উঠল আমার। চাচীকে বিপদে রেখে আমি কী না
যাচ্ছি মাছ কিনতে? নিজের উপরে রাগ জমে গেল মুহুর্তেই। আগে চাচীর প্রাণ বাঁচানো এরপরে
রসনা বিলাস। হৃদয়টা স্পষ্ট নির্দেশ পাঠালো মস্তিষ্কে। মস্তিষ্ক পায়ে নির্দেশ পাঠানোর
আগেই পা দুটো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলা শুরু করে দিলো দোতলার দিকে।
কে
হতে পারে মেয়েটা? ইতিহাস জুড়েই মেয়েরা অপরাধের সাথে কম যুক্ত নেই। অনেকে যেমন তাদের
মোহময়তা কাজে লাগিয়ে বিখ্যাত আবার অনেকে তাদের নির্দয়তার উদাহরন সৃষ্টির কারনে। এই
অপুর্ব সুন্দর মেয়েটা যে অপরাধী তা মানতে মন সায় দিচ্ছে না। আবার মোবাইলে আসা মেসেজ
আর এই ঘটনা নিতান্ত কাঁকতাল তো নয়ই। তার উপরে যার কাছ থেকে নির্দেশনা আসছে তার পরিচয়
পাওয়া আদৌ সম্ভব কী না তা-ও ভাবনার ব্যাপার। আর পরিচয় আপাতত যা পাওয়া গেলো তাতে তো
আরো ভয়ানক ব্যাপার! একটা মৃত মানুষের সাথে আমার যোগাযোগ হচ্ছে তাও প্রযুক্তি ব্যবহার
করে! কেউ শুনলে নির্ঘাত আমায় পাঠাবে মানসিক হাসপাতালে। আশপাশে মানসিক হাসপাতাল কোথায়
আছে ভাবতে ভাবতে দোতলায় পৌছে গেলাম।
দোতলায়
উঠে দেখলাম মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। দরজা এখনও খোলা হয়নি। মেয়েটা এক নজর তাকালো
আমার দিকে। আবার সেই প্রান ধরে টান মারা হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এত তাড়াতাড়ি বাজার
শেষ?’
একটু
অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মাথায় দারুন বুদ্ধি চাপল। বললাম, ‘মানিব্যাগটা বাসায় রেখে এসেছি
আসলে, ভুলে’। ক্যাবলা এক হাসি দিলাম তাকে উদ্দেশ্য করে।
আগের
চেয়ে বেশি সুন্দর করে হেসে মেয়েটা জিজ্ঞাসা করল, ‘তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে কেন? বাসায় যান।
মানিব্যাগ নিয়ে আসুন।‘
এই
হাসি আর সার্কাজমের শিকার হওয়ার পরে মাথায় আর কোন কাজ করছিল না। প্রকৃতি কেন যে মেয়েদের
এত সুন্দর করে হাসার মত এক বায়োলজিকাল অস্ত্র দিয়েছে? কোন উত্তর না দিয়ে সিড়ি বেয়ে
উপরে উঠতে লাগলাম। দুই সিড়ি উঠতেই রওশন আন্টি দরজা খুলে বের হলেন। আমিও ঘুরে দাঁড়ালাম।
বলা তো যায়না। মেয়েটা যদি হিট এন্ড রান করে বসে!
‘কে
আপনি? কাকে চাচ্ছেন?’- স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্জের সাথে আন্টি জিজ্ঞাসা করলেন মেয়েটাকে।
মেয়েটা
আন্টির দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। যেন পরম আরাধ্য কোন কিছু দেখছে। অনেক অপেক্ষার
পরে কোন কিছু পেলে যেভাবে তাকিয়ে থাকে! হয়ত মনে মনে ভাবছে শিকার তার হাতে! এই অপরুপার
হাত থেকে বাঁচাতেই হবে আন্টিকে। সে যেভাবেই হোক।
‘আমি
এসেছি নাটোর থেকে। মুরাদপুর এর কাওসার মোল্লা আমার মামা’- কাটা কাটা গলায় বলল মেয়েটা।
আন্টির
চোখ যেন বিস্ফোরিত হয়ে যাবে এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন মেয়েটার দিকে। তার ফর্সা অভিজাত মুখটা
যেন আতঙ্কে নীল হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। মনে হচ্ছে তিনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। কিন্তু, সামলে
নিলেন নিজেকে। মেয়েটাকে ইশারা করলেন ভেতরে আসতে। আমার দিকে তাকালেন ঘরের ভেতরে ঢোকার
আগে একবার। তার চোখে মুখে কিছু একটা লুকোনোর ভাব স্পষ্ট।
দরজা
বন্ধের আওয়াজ পেলাম। কিন্তু উপরে যেতে মন চাচ্ছে না। যদি কোন বিপদ হয়! মন চাচ্ছে দরজায়
কান দিয়ে শুনি ভিতরে কী চলে। কিন্তু, কেউ যদি দেখে যে একজন ভদ্রলোক অন্য কোন ঘরের দরজায়
কান পেতে আছে একদম কেলেংকারি হয়ে যাবে। তার চেয়ে এখানেই আর কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ভালভাবে
বোঝা ভাল কী চলছে।
মিনিট
দুয়েক দাঁড়িয়ে থেকে কোন সারা শব্দ পেলাম না। তিন তলার দিকে পা বাড়ানো মাত্রই রওশন চাচীর
ফ্লাট থেকে ভেসে এলো কান্নার শব্দ। তাও একজনের না দুজনের। মানে মেয়েটা আক্রমন করেছে
চাচী আর বুয়াকে!