কলেজে
সেদিনই প্রথম দিন ফজলে রাব্বির। এস এস সি, এইচ এস সি পরিক্ষায় ভাল ফলাফল করে উচ্চ
শিক্ষার জন্য ভাল একটা কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিল সে। অবশেষে তিতুমির কলেজে হিসাব
বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হল। সেদিন ছিল এই ব্যাচের ক্লাস আরম্ভ হবার কথা। ক্লাস রুমের
প্রথম বেঞ্চে বসে ছিল সে। একা নয় অবশ্যই। আড্ডাবাজ ছেলেরা যেখানেই যাক আগে গ্যাং
বানিয়ে নেয়। রাব্বিও তার ব্যাতিক্রম নয়। সবার সাথে ধুন্ধুমার আড্ডা চলছিল পরিচয় পর্ব সারার পর। হঠাৎ আড্ডায় ব্যাঘাত ঘটল
এক সু কণ্ঠির ডাকে।
‘অনার্স
৩০ ব্যাচের ক্লাস কি এখানে?’- সুকণ্ঠি শুধাল মধুমাখা গলায়।
রাব্বি
সহ সবার দৃষ্টি তার দিকে। যথেষ্ট সুন্দর মেয়ে। প্রায় সবার ঘাড় ডানদিকে ঘুরে গেল
সম্মতি জানাতে, শুধুমাত্র রাব্বির বাদে। সে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে একদৃষ্টিতে।
মেয়েটা রাব্বির এহেন দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরেই হয়তো দ্রুত প্রস্থান করল সেখান
থেকে।
রাব্বির
ভ্রম ভাংল পিছন থেকে খোঁচা খেয়ে। আমির হাসতে হাসতে বলল, ‘মামা ওদিকে নজর দিওনা।
আইটেম টা আমার’। ‘তাইতো দেখছিলাম, তোর সাথে কেমন
মানায়’ রাব্বি হেসে জবাব দিল।
তবে
গ্যাঙের সবার ভুল ভাংতে দেরি হলনা। কারন মেয়েটা ছিল হিঁদু। নাম অর্পিতা সাহা। খুব
ফ্রেন্ডলি। ফ্রেন্ডলি টাইপ মেয়েরা সচরাচর প্রেমের ফাদে পা দেয়না। তাই সবাই একযোগে
পদত্যাগ করল ক্যান্ডিডেসি থেকে। রাব্বি এক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম। কারন, ওর মুখচোরা
স্বভাব, বিশেষত মেয়েদের ব্যাপারে। মনে মনে তাকে পছন্দ করলেও কারও সামনে সে প্রকাশ
করলনা যে সে অর্পিতাকে পছন্দ করে। তাছাড়া ক্লাসের অনেক রথী মহারথী রা তখনও
অর্পিতাকে প্রেমের অফার দিয়ে ব্যাতিব্যাস্ত করে রেখেছিল। তারা ফেল খাওয়ায় রাব্বি
আর ওমুখো হতে চাইলনা। আর মেয়েটা ছিল সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণকারী। সেটাও
অবশ্য কারন ছিল আরেকটা। ক্লাসের সব ছেলেদের সাথে আড্ডা বাজিতে রাব্বি ছিল নম্বর
ওয়ান। কিন্ত ক্লাসে যে নারিজাতি ছিল তাদের কারো সাথেই রাব্বির আলাপ ছিলনা তেমন
একটা। কারন মেয়েদের সামনে গেলেই তার হাঁটু কাপার রোগ ছিল সেই ছোটবেলা থেকে। এভাবেই
চলে গেল প্রথম বর্ষ।
প্রথম
বর্ষে রাব্বির রেজাল্ট হল গ্যাঙের সবার চেয়ে খারাপ। কারন টিউশন আর অন্যান্য
পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে রাব্বি পড়াশোনা একদম ই করতে পারেনি। অর্পিতা আবার ছিল
বেস্ট রেজাল্ট ধারিদের মধ্যে অন্যতম। তাই রাব্বি একরকম বাধ্য হয়েই ড্রপ আউট করল
মনে মনে। অবশ্য তার এই ড্রপ আউটের কথা কারো জানার কথা নয়। আর সবাই জানত সে পছন্দ
করে বাইরের একটা মেয়েকে যার কিনা এরি মধ্যে বিবাহ হয়ে গেছে। তাই নারী বিষয়ে কেউ
তাকে ঘাঁটাত না।
দ্বিতীয়
বর্ষে উঠে একজনের সাথে খুব ভাল বন্ধুত্ব হল রাব্বির। বন্ধু টা ছিল আগের ব্যাচ থেকে
ডাউন খাওয়া রনি। তবে অন্যান্য বন্ধু বান্ধবের সাথেও তার বন্ধুত্ব ছিল অটুট। আমির, শামিম,
জাবেদ, হাসান, মুসা, তুহিন বাওয়ালী, মনোজ আর রাব্বি সর্বদা একসাথেই থাকত। হাসানের
অব্যাক্ত প্রেমের সাক্ষি হয়ে ছিল সবাই। হাসান অন্য বিভাগের এক কন্যা কে প্রচণ্ড
পছন্দ করত। তাই হাসান কে সঙ্গ দিতে হত সবার। মেয়েটার পিছন পিছন যেতেও হাসানের একজন
বন্ধুর সাহায্য লাগত। সেক্ষেত্রে প্রায় সবাই অবদান রাখত। রাব্বিও ভাবল এবার তবে
শুরু কড়া যাক নতুন প্রেম খোঁজা। খুজে পেতে দেরি হলনা। ওর বিভাগের এক জুনিয়র মেয়েকে
দেখে রাব্বির মনে আইলা ঝড় উঠল। ঝড়ের তিব্রতা তার বন্ধু বান্ধব সবার মাঝে দেখা গেল।
এমনকি পুরো ক্লাস জেনে গেল এই ঝড়ের কথা। অবস্থা এমন হল রাব্বি একা একা মেয়েকে
দেখতে যায়। পিছন ফিরলেই দেখে আরও দশজন বন্ধু সেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই
অভিনন্দন আর প্রেম করার টিপস দিতে থাকে তাকে। তবে জানা গেল রাব্বির পছন্দের মেয়েটা
হিঁদু। একেবারে বড় বংশের মেয়ে। অর্পিতা ফ্রেন্ডলি টাইপের মেয়ে আগেই বলেছি। তাই
এবার সেও এগোল রাব্বিকে টিপস দিতে।
এবার
রাব্বির মনবল আগের চেয়ে দশগুন বেশি। তাই সে দেরি না করে জানিয়ে দিল মেয়েটাকে
ভালবাসার কথা। মেয়েটা আজ জানাই কাল জানাই করতে করতে সময়ক্ষেপণ করতে লাগল। এদিকে
অর্পিতার সাথে ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল রাব্বির। এক এক দিন যায়, রাব্বির সাথে
অর্পিতার সম্পর্ক আরও গভীর হয়। হঠাৎ একদিন সেই মেয়েটা রাব্বিকে জানাল প্রেম সম্ভব
না। রাব্বিও আবার হিট খেয়ে মনমরা হয়ে গেল।
এদিকে
অর্পিতার মনের মধ্যে ঝড় উঠেছে রাব্বিকে নিয়ে। রাব্বির এতটাই কাছে পৌঁছে গেছে সে যে
তার মনের মধ্যে অজান্তে ফুটে গেছে ভালবাসার ফুল। রাব্বির মন খারাপ। তাই সে সবাইকে
এড়িয়ে চলে কিছুদিন, এমনকি অর্পিতাকেও। অর্পিতার এই এড়িয়ে চলা ভাল লাগেনা। তাই সে
রাব্বির আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে পরে। আস্তে আস্তে রাব্বিও স্বাভাবিক হয়।
রাব্বি
কিছু না বুঝলেও বন্ধুরা বুঝতে পারে কি ঘটতে যাচ্ছে। বিশেষ করে রনি বুঝতে পারে সবার
আগে। রাব্বির প্রায় প্রতিটা কাজের আগে অর্পিতার পরামর্শ নিতে হয়। অর্পিতাও তাকে
সময় দেয় নিঃস্বার্থ ভাবে। রনি বুঝতে পারে রাব্বি অর্পিতার প্রতি দুর্বল। তাই সে
একটা ব্লু প্রিন্ট আঁকে, দুজন কে এক করার জন্য। রনি বুঝতে পারে দুজন দুজনাকে
ভালোবাসে কিন্তু বন্ধুত্তের বৃত্ত ভেঙ্গে কেউ এগোতে পারছেনা সামনে। তাই রনি শুরু
করে খেলা। অর্পিতা কে গিয়ে বলে রাব্বি তোমাকে ডেকেছে সেমিনারে। আর রাব্বিকে বলে
তুই সেমিনারে গিয়ে বয় আমি আসতেছি। অর্পিতা সেমিনারে যায় আর রাব্বির সাথে কথা বলে।
আর রনি দূরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে নতুন প্লান কষে। এভাবেই চলে যায় আরও দুই বছর।
ফাইনাল
ইয়ারে এসেও রাব্বি বা অর্পিতা কেউ কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি তাদের মনের কথা। আর
রনিও রাব্বিকে প্রতিদিন বলতে থাকে অর্পিতাকে প্রস্তাব করার জন্য। রাব্বি এড়িয়ে যায়
বন্ধুত্বের কথা বলে। পুরো ক্লাসে অবশ্য ফিস্ফাস চলছে রাব্বি আর অর্পিতা কে নিয়ে।
অর্পিতার কানেও এসব যায় কিন্তু সে এসব নিয়ে কখনও কিছু বলেনা কারন সে তো জানে যে সে
রাব্বিকে পছন্দ করে। কিন্তু হিঁদু- মুসলিম বিভেদ আর বন্ধুত্বের খাতিরে সেও এগোতে
পারেনা। অবশেষে একদিন রাব্বি অর্পিতাকে সরাসরি বলে তার মনের কথা। অর্পিতাও এড়াতে
পারেনা তার কথা। শেষ পর্যন্ত একটা হ্যাপী এন্ডিং ঘটে এই প্রেমের।
রাব্বি
হয়তো কোনদিন ই বলতনা অর্পিতাকে তার প্রেমের কথা। কিন্তু এড়াতে পারেনি একজনের জন্য।
সে হল রনি। রনির বুদ্ধিতে জাবেদ অর্পিতার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়। আর আড্ডায় অর্পিতাকে
নিয়ে গল্প করে রাব্বির সামনে। রাব্বি তো অর্পিতাকে ভালোবাসে প্রচণ্ড, তাই তার কাছে
এসব ভাল লাগেনা। যার কারনে রাব্বির নিরুপায় হয়ে বলতেই হয় ভালবাসার কথা। সেই জাবেদ
হলাম আমি। পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। আর ওদের মিলিয়ে দেবার জন্য ম্যাচমেকারের
ভুমিকা পালন করে কিছু ক্রেডিট আমি নিতেই পারি...
No comments:
Post a Comment